Thursday, May 31, 2012

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

লক্ষ্য :
শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, মানবিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধন এবং তাকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করা।


উদ্দেশ্য:
  • শিক্ষার্থীর মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’য়ালার প্রতি অটল আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে তোলা। যেন এই বিশ্বাস তার চিন্তা ও কর্মে অনুপ্রেরণা যোগায় এবং আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে সহায়তা করে।
  • স্ব স্ব ধর্মের অনুশাসন অনুশীলনের মাধ্যমে শিশুকে নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনে সহায়তা করা।
  • শিশুর মনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা, সাম্য, সহমর্মিতা ও সহযোগিতাবোধ জাগানো এবং তাকে শান্তিময় পরিবেশের প্রতি আগ্রহী করে তোলা।
  • শিশুর মনে মানবাধিকার, পারস্পরিক সমঝোতা, সহযোগিতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, আন্তর্জাতিকতাবোধ এবং বিশ্বশান্তি ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তোলা।
  • কায়িক শ্রমের প্রতি আগ্রহ ও শ্রমজীবি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগানো এবং অর্থপূর্ণ শ্রমের মাধ্যমে জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়তা করা।
  • পারিবারিক, সামাজিক ও বিদ্যালয়ের কর্মকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিশুকে তার নিজের ও অপরের অধিকার, কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।
  • শিশুকে পরমত সহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুশীলনের অভ্যাস গঠনে সহায়তা করা।
  • মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে শিশুর মনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটানো, ত্যাগের মনোভাব সৃষ্টি করা এবং দেশগঠনমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করা।
  • জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি লাভে সহায়তা করা এবং এগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তোলা।
  • শরীরচর্চা ও খেলাধূলার মাধ্যমে শিশুর শারীরিক বিকাশে সহায়তা করা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করা।
  • জীবন পরিবেশে কার্যকর ব্যবহারের জন্য এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার সকল মৌলিক দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা।
  • শিশুকে গাণিতিক ধারণা ও দক্ষতা এবং যৌক্তিক চিন্তা ও সমস্যার সমাধানের যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করা।
  • বিদেশী ভাষা হিসেবে ইংরেজির প্রাথমিক দক্ষতা অর্জন এবং এ ভাষা ব্যবহারে সহায়তা করা।
  • শিখন-দক্ষতা ও জ্ঞানের প্রতি যথার্থ কৌতুহল সৃষ্টি করে আজীবন শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করা।
  • জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান অর্জন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনে সমস্যা সমাধানের অভ্যাস গঠন এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়তা করা।
  • তথ্যের উত্স, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার, প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ সম্পর্কে ধারণা লাভে সহায়তা করা।
  • শিশুকে পরিবেশ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে সহায়তা করা এবং পরিবেশের দূষণরোধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এর উন্নয়ন ও সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করা।
  • সঙ্গীত, চারু ও কারুকলা ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সৃজনশীল, সৌন্দর্যচেতনা, নান্দনিকবোধ ও বুদ্ধির বিকাশ ও সৃজনশীলতার ও সৌন্দর্য উপভোগে সহায়তা করা।
  • সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও সংরক্ষণে যত্নশীল হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সহায়তা করা। 
  • শিক্ষার্থীর মধ্যে ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, শিষ্টাচার, মিলেমিশে বাস করার মানসিকতা ইত্যাদি বাঞ্ছিত নৈতিক ও সামাজিক গুণাবলি বিকাশে সহায়তা করা।
  • মানুষের মৌলিক চাহিদা ও পরিবেশের উপর জনসংখ্যার প্রভাব সম্পর্কে ধারণা লাভ এবং এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়তা করা।
  • শিক্ষার্থীর সামর্থ্য প্রবণতা ও আগ্রহ অনুসারে তাকে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা এবং পরবর্তী স্তরের শিক্ষা লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা।

একীভূত শিক্ষা

একীভূত শিক্ষা

আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে চালু করা হয়েছে একীভূত শিক্ষা। অতীতেও ছিল তবে বর্তমানে এ শিক্ষাকে অধীকতর জোরদার করা হয়েছে। আর এ জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে একীভূত শিক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ শিক্ষার গুরুত্ব অপরীসিম।
একীভূত শিক্ষা:
একীভূত কথাটার অর্থ হলো সমাজের সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ। একীভূত শিক্ষা হলো সকল শিশুকে মূলধারার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এনে একসাথে শিক্ষা দেয়া।
একীভূত বিদ্যালয়:
সকল শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আবেগ-অনুভূতি, বিশ্বাস, ধর্ম, ভাষা বা অন্য কোন বিভিন্নতা থাকা সত্বেও একই বিদ্যালয়ে আসতে বাধা দেয়া যাবে না। একই বিদ্যালয়ে যাতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, শ্রমজীবি শিশু, পথ শিশু, যাযাবর সম্প্রদায়ের শিশু, উপজাতীয় বা ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার শিশু এবং সুবিধা বঞ্চিত বিভিন্ন পরিবারের শিশুরা যাতে শিক্ষা অর্জন করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
একীভূত শিক্ষার বৈশিষ্ট্য:
  • প্রত্যেক শিশুর শিক্ষার অধিকার রয়েছে এবং তাদের মূলধারার শিক্ষায় সমানভাবে অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে;
  • শিক্ষা থেকে বাদ পড়তে পারে এমন বাধাসমূহ চিহ্নিত ও অপসারণ করা;
  • শুধু স্কুলে ভর্তি করা নয় বরং সকল শিশুর পরিপূর্ণ অংশগ্রহণ ও শিক্ষা অর্জন নিশ্চিত করা;
  • শিশুদের বিভিন্নতা, বৈচিত্রতা ও পার্থক্যগুলোর প্রতি ইতিবাচক সাড়া প্রদান করা;
  • শিখন-শেখানো কার্যক্রমের গুণগতমান উন্নয়নের মাধ্যমে সকল শিশুর শিক্ষার চাহিদা পূরণ করা।



একীভূত শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:

  • পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের প্রতিটি শিশুর শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করা;
  • প্রত্যেক শিশুর চাহিদা ও সম্ভাবনা অনুযায়ী শিখন ও জ্ঞান অর্জনের প্রতিবন্ধকতা সীমিত ও দূরীকরণের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করা;
  • প্রতিটি শিশুই আলাদা এবং অনন্য- এই চিরায়ত সত্যকে মেনে নিয়ে প্রত্যেকের জন্য স্কুলে অবাধ শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
একীভূত শিক্ষার সুফল:
শিশুর সুফল:
  • সকল শিশু মুক্তভাবে শিখন-শেখানো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে;
  • সকল শিশু আত্মবিশ্বাস ও নিজস্বতাবোধ অর্জন করে;
  • সকল শিশু বৈচিত্র্যকে বুঝতে ও সম্মান করতে শেখে;
  • প্রত্যেকেরই ভিন্নতা ও ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা রয়েছে- সব শিশু তা বুঝতে পারে;
  • সকল শিশুই মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করে;
  • প্রত্যেক শিশু একে অপরের সহায়তাকারী হিসেবে বেড়ে উঠে।
শিক্ষকের সুফল:
  • শিখন-শেখানো কার্যক্রম বেশি শিশু-কেন্দ্রিক, কার্যকর ও সৃজনশীল হয়;
  • সমাজ ও অন্যান্য ব্যবস্থা থেকে শিক্ষক বেশি সহযোগিতা পেয়ে থাকেন;
  • শিখন-শেখানো কার্যক্রমে শিক্ষক সন্তষ্ট হন এবং তাঁর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।
অভিভাবকের সুফল:
  • শিশুর শিখনের সঙ্গে অভিভাবক আরো বেশি সম্পৃক্ত হন;
  • বিদ্যালয়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন কৌশল শেখার মাধ্যমে অভিভাবকের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটে;
  • বিদ্যালয়ের কার্যক্রমে অভিভাবকদের বেশি সম্পৃক্ততার কারণে শিশুর শিক্ষা ও সমস্যা সম্পর্কে বেশি সচেতন হন।
সমাজের সুফল:
  • অধিক হারে শিশু বিদ্যালয়ে গমন ও শিখন-শেখানো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখে;
  • আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ আরো বৃদ্ধি পায়;
  • সমাজের বিভিন্ন সমস্যা, অপরাধ প্রবণতা ইত্যাদি কমে আসে;
  • বিদ্যালয়ের কার্যক্রমে অধিকহারে সম্পৃক্ততা বিদ্যালয় ও সমাজের মধ্যে সম্পর্কের প্রভূত উন্নতি ঘটায়।
জাতি তথা রাষ্ট্রের সুফল:
  • একীভূত সমাজ গঠিত হয়;
  • সকলের জন্য শিক্ষার লক্ষ্য অর্জিত হয়।
একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রতিবদ্ধকতা:
  • একীভূত শিক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের স্বল্পতা;
  • একীভূত শিক্ষা বিষয়ে উপযোগী কারিকুলাম ও শিক্ষা উপকরণের স্বল্পতা;
  • অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাযুক্ত বিদ্যালয়;
  • সকল শিশুর (বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুসহ) শিক্ষার অধিকার রয়েছে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব;
  • সমাজের সকল স্তরের জনগোষ্ঠীর শিশুর বিশেষ করে সুবিধা বঞ্চিত ও প্রান্তিক শিশুদের শিক্ষার বিষয়ে সচেতনতার অভাব।
একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জসমূহ:
  • একীভূত শিক্ষা বিষয়ে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের পরিবর্তন;
  • সকল পর্যায়ে বিশেষ করে নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও বোধগম্যতা তৈরি;
  • শিক্ষক ও মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান;
  • বর্তমান কাঠামোর মাঝে থেকে সঠিক এবং উপযোগী শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করা;
  • উপযোগী শিখন-শেখানো উপকরণ ও শিখনসামগ্রী সরবরাহ এবং তার ব্যবহার;
  • সকল শিশুর শিখনের প্রতি লক্ষ্য রেখে নমনীয় কারিকুলাম, সময়সূচি এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন;
  • প্রত্যেক শিশুর শিখন চাহিদার উপর ভিত্তি করে তার উপযোগী প্রতিবদ্ধকতাবিহীন এবং শিশু-কেন্দ্রিক শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা।



সংগ্রহ: দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে সংগৃহীত।

প্রাথমিক শিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষা

বিশ্বব্যাপী আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রধানত তিনটি স্তরে বিন্যস্ত: প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা। এই শিক্ষা কাঠামোর প্রারম্ভিক ধাপই হচ্ছে প্রাথমিক বা মৌলিক শিক্ষা। যে কোন দেশের আর্থ সামাজিক পেক্ষাপট, রাজনৈতিক অংগীকার ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞান প্রয়োগ ক্ষমতার উপর সাধারণত প্রাথমিক শিক্ষাসহ অন্যান্য শিক্ষাস্তরের মেয়াদকাল, বিন্যাস ও বিস্তার বহুলাংশে নির্ভরশীল। তবে সব দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ  বিষয় হিসাবে স্বীকৃত।
প্রাথমিক শিক্ষা বলতে শিক্ষা প্রক্রিয়ার প্রথম বা ভিত্তি স্তরকেই বুঝানো হয়ে থাকে। সাধারণ অর্থে  শিক্ষার প্রথম স্তরটি জীবনের যে কোন সময়েই সূচিত হতে পারে। কারো বেলায় এটা শৈশব কাল থেকেই শুরু হতে পারে। আবার কারো বেলায়, যেমন নিরক্ষর বয়স্কদের বেলায় এটা পরিণত বয়সেও শুরু হতে পারে। কাজেই প্রাথমিক শিক্ষা কথাটি কিছুটা ধারণাগত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। শিক্ষাথীর বয়সের দিক বিবেচনা করলে এটি পাঁচ বা চয় বছর থেকে এগার-বার বা তের বছর বয়সী শিশুদের শিক্ষা স্তর। আবার শিক্ষার বিষয়ের দিক থেকে এটি এমন একটি শিক্ষাস্তর যেখানে শিশুরা লেখা, পড়া ও পাটি গণিত শেখার সংগে সংগে স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং সামজিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার বিষয়েও শিক্ষা লাভ করে থাকে। শ্রেণী ব্যাপ্তির দিক থেকে প্রাথমিক শিক্ষা কোন কোন দেশে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত, আবার কোন কোন দেশে প্রথম থেকে ষষ্ঠ বা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত। কাজেই প্রাথমিক শিক্ষার স্বরূপ ও প্রকৃতি নানা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বটে। তবে, বর্তমানে শিক্ষাবিদগণ প্রাথমিক শিক্ষাকে সামাজিক ও মনোবৈজ্ঞানিক দিক থেকে বিচার করার উপরই অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন।
বর্তমান বিশ্বে সব রাষ্ট্রই প্রাথমিক শিক্ষার বেশিরভাগ দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। আর এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য রাষ্ট্র বিশেষ সুবিধা সৃষ্টি করে। তাই প্রাথমিক শিক্ষা বলতে বর্তমানে শিশুর সমগ্র শিক্ষাকালের সেই অংশকে বুঝানো হয়, যে সময় প্রত্যেক শিশুরই শিক্ষালয়ে থাকা উচিত।
সাধারণত সকল সমাজেই শিশুদের মধ্যে পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকে এগার-বার বয়স পর্যন্ত সময়কালে নিজ নিজ পারিবারিক বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার মনোবৈজ্ঞানিক ও সামাজিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময়কালে তারা তাদের শারীরিক কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে, খেলাধূলায় অংশগ্রহণ করতে পারে এবং নিজেদের চাহিদা ও মনোভাব প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। এছাড়া তারা সমবয়সীদের সাথে মিলে মিশে বৌদ্ধিক ও সামাজিক ‍শিখন আরম্ভ করে। এই বয়:স্তরের অর্থাত শৈশবকাল ও বয়সন্ধিকালের মধ্যবর্তী সময়কালের শিশুদের জন্য আয়োজিত আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমকেই সাধারণ অর্থে সকল রাষ্ট্র বা সমাজে প্রাথমিক শিক্ষা বলে অবিহিত করা হয়।

বিদ্যালয়ে শারীরিক শাস্তি বিষয়ে বাংলাদেশী শিশুদের মতামত

বিদ্যালয়ে শারীরিক শাস্তি বিষয়ে বাংলাদেশী শিশুদের মতামত

সূত্র: ইউনিসেফ কর্তৃক শিশুদের মতামত জরিপ ২০০৮ হতে।
এখনো বাংলাদেশের অনেক শিশুকে তাদের দৈনন্দিন জীবনে বাড়িতে, বিদ্যালয়ে ও কর্মস্থলে শারীরিক শাস্তির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। যদিও শিশু অধিকার সনদে সকল শিশুর মর্যাদাপূর্ণ ও শারীরিকভাবে শাস্তিমুক্ত আচরণ পাবার কথা বলা আছে কিন্তু শারীরিক শাস্তি বিষয়ে আইনী ব্যবস্থার অনুপস্থিতির সুযোগে শৃঙ্খলা বিধানের নামে পিতামাতা, শিক্ষক ও কর্মস্থলের ব্যবস্থাপকগণ শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শাস্তি দেন।
জরিপকালে শিশুরা জানিয়েছে যে, বিদ্যালয়ে সকল ধরণের শিক্ষা পরিবেশেই শারীরিক শাস্তি প্রদানের ঘটনা অনেক বেশি (৯১%)। শাস্তির পৌনঃপুনিকতা ও ধরন শিশুর বয়স, জেন্ডার ও আর্থসামাজিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। শারীরিক শাস্তি সবচেয়ে কম পায় ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েরা (৮১%) এবং সবচেয়ে বেশি শারীরিক শাস্তি পায় ৯ থেকে ১৩ বছর বয়সী ছেলেরা (৯৮%)। 
সর্বাধিক ব্যবহৃত শাস্তির ধরণগুলোর মধ্যে রয়েছে ধমক দেয়া/তিরস্কার করা/ভত্সনা করা (৯৭ শতাংশ), হাতের তালুতে বেত বা লাঠি দিয়ে আঘাত করা (৭৬ শতাংশ), শ্রেণীকক্ষে দাঁড় করিয়ে রাখা (৬৩ শতাংশ), শরীরের অন্যান্য স্থানে বেত/লাঠি দিয়ে মারা (৬০ শতাংশ), চড় মারা (৪৯ শতাংশ), কান বা চুল ধরে টানা কিংবা চামড়া ধরে মুচড়ে দেয়া (৩৬ শতাংশ) এবং কান ধরে হাঁটুর উপর দাঁড় করিয়ে রাখা (২৫ শতাংশ)। শাস্তির ব্যাপকতা এতো বেশি যে, ৫৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে যে তারা শারীরিক শাস্তি ভোগ করে, প্রায় ২৩ ভাগ শিক্ষার্থী বলেছে যে, এই ধরণের শাস্তির ঘটনা বিদ্যালয়ে প্রতিদিনই ঘটে। প্রায় ৭ শতাংশ শিশু শারীরিক শাস্তির কারণে শরীরের অংশ কেটে যাওয়া কিংবা আঘাত পাওয়ার কথা জানিয়েছে। 
সামগ্রিকভাবে, শিশুদের বিবেচনায় বিদ্যালয়ে শারীরিক শাস্তি গ্রহণযোগ্য, প্রায় ৭৫ ভাগ শিশু বিনাবাক্যব্যয়ে এই ধরণের শাস্তি মেনে নেয়ার পক্ষপাতি এবং প্রায় ১২ ভাগ শিশু সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে শারীরিক শাস্তিকে অনুমোদন করে। মাত্র ৬ শতাংশ শিশু বলেছে যে, শারীরিক শাস্তি কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। দলভিত্তিক আলোচনায় শিশুরা বলেছে যে, এই ধরণের শাস্তি শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের পড়া তৈরিতে অধ্যাবসায়ী হতে ও সঠিক পথে চলতে সহায়তা করে। তবে সকল শিশু তুলনামূলকভাবে কম মারাত্মক ধরণের শৃঙ্খলা বিধানের পক্ষে মত দিয়েছে।
সহপাঠীদের সামনে শারীরিক শাস্তি প্রদানকে শিশুরা শারীরিক ক্ষতির চেয়েও অনেক বেশি মানসিক লজ্জার বিষয় মনে করে। বিশেষ করে, সহ-শিক্ষা আছে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছেলেদের জন্যে এই ঘটনা বেশি লজ্জাজনক।

শিক্ষক ঘাটতি ও শিক্ষার্থীর অনিয়মিত উপস্থিতি প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের প্রধান সমস্যা

প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষার মূল ভিত্তি। গ্রামে ধনী-দরিদ্র সকল শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়েই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণ গত মান বৃদ্ধি হলেও গুণগত মান বৃদ্ধি হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে শিক্ষক ঘাটতি ও শিক্ষার্থীর অনিয়মিত উপস্থিতি। এছাড়াও অন্যান্য কারণ রয়েছে।
শিক্ষক ঘাটতি:
আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কোনটি এক শিফটে আবার কোনটি দুই শিফটে পরিচালিত হয়। এক শিফট বিশিষ্ট বিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত ৫জন শিক্ষক পদ রয়েছে। অন্যদিকে দুই শিফট বিশিষ্ট বিদ্যালয়গুলিতে ৪ জন শিক্ষক পদ রয়েছে। ৫ জন এর অধিক পদ রয়েছে এরকম বিদ্যালয়ের সংখ্যা অতি নগন্য। এক শিফটে পরিচালিত বিদ্যালয়সমূহে যদি কোন শ্রেণীর শাখা না থাকে তবে সকাল থেকে একই সাথে ৫টি শ্রেণীর (১ম-৫ম) শ্রেণী কার্যক্রম শুরু হয়। এ কার্যক্রম চলে বিরতির আগ পর্যন্ত। এখানে সর্বক্ষণ ৫জন শিক্ষক থাকতেই হবে। অথচ বেশীর ভাগ বিদ্যালয়গুলোতেই শিক্ষক ঘাটতি বিরাজ করে। এছাড়াও রয়েছে শিক্ককের নৈমিত্তিক ছুটি, চিকিত্সা ছুটি, প্রসূতি ছুটি। একজন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে একটি শ্রেণীর কার্যক্রম কি করে সম্ভব তা সহজেই কল্পনা করা যায়। একজন শিক্ষককে একইসাথে ২টি শ্রেণীর কার্যক্রম চালাতে হয়। এ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে ২টি শ্রেণীরই শ্রেণী কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে শিক্ষার্থীকে শিখন ফল পুরোপুরি অর্জন করানো সম্ভব হয় না। চলতে থাকে শিখন ঘাটতি। যা পরবর্তীতে গুণগত মান উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করে। অপরদিকে দুই শিফট বিশিষ্ট বিদ্যালয়ে সবসময় শিক্ষক ঘাটতি বিরাজ করে। এমনও অনেক বিদ্যালয় আছে যেখানে একজন শিক্ষক পুরো বিদ্যালয় চালাচ্ছেন মাসের পর মাস। শিক্ষক ঘাটতি কোন সময়ই পূরণ হচ্ছে না। নতুন শিক্ষক নিয়োগ করা হলেও তারা চলে যায় এক বছরের জন্য সি-ইন-এড প্রশিক্ষণে। ফলে পদটি শূন্যই থেকে যায়। আবার নিয়োগ প্রাপ্তির পর শিক্ষক পদ পূরণ হলেও কোন শিক্ষক অবসর গ্রহন করলে তত্ক্ষণাত শিক্ষক নিয়োগের কোন ব্যবস্থা নেই। পরবর্তী নিয়োগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বলা যায় যে, শিক্ষক ঘাটতি চলমান থাকে। 
শিক্ষার্থীর অনিয়মিত উপস্থিতি:
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর বাত্সরিক গড় উপস্থিতি প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ। ১০০ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করা এখনও সম্ভব হয়নি। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে। যদি ধরে নেয়া হয় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বছরের প্রদতিদিনই বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। বাকী ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বছরের একাধিক দিন অনুপস্থিত থাকে। পাঠ দানের জন্য বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথম শ্রেণীতে গণিত বিষয়ের কথাই ধরা যাক। প্রথম দিন ১ ও ২ শেখানো হলো। পরের দিন ৩ ও ৪। যদি কোন শিক্ষার্থী পরপর দুই দিন অনুপস্থিত থাকে তবে সে ১, ২, ৩ ও ৪ শিখতে পারবেনা। ফলে তার শিখন ঘাটতি থেকে যাবে। এটা পূরণ করা সম্ভব নয়। এভাবে সকল বিষয়ে চিন্তা করলে শিক্ষার গুনগত মানের বিষয়টি সহজেই কল্পনা করা যায়।
বিরামহীন পাঠদান:
শিক্ষক সাধারণত বিরামহীনভাবে পাঠদান করেন। অর্থাত একটি শ্রেণী কার্যক্রম শেষ করে সাথেসাথেই আর একটি শ্রেণী কার্যক্রম শুরু করতে হয়। এভাবে চলে বিরতি পর্যন্ত। মাঝখানে একটুকুও বিরাম নেই। অথচ প্রতিটি পাঠদানের পূর্বে শিক্ষকের পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া পাঠদান ফলপ্রসু করা সম্ভব নয়।
শিক্ষকের আন্তরিকতার অভাব:
শিখন-শেখানো কার্যক্রম একটি টিম ওয়ার্ক। এখানে সকল শিক্ষককেই আন্তরিকতার সাথে পাঠদান করতে হবে। তানা হলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। অনেক শিক্ষক আছেন দায়সারা গোছের পাঠদান করে থাকেন।
শিক্ষক নির্দেশিকার অভাব:
অনেক জটিল বিষয় আছে যা পাঠদানের জন্য শিক্ষক নির্দেশিকার প্রয়োজন। কিন্তু বার বার পাঠ্য পুস্তক পরিবর্তনের ফলে পুরাতন নির্দেশকা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়েছে। এখন পর্যন্ত শিক্ষক নির্দেশিকা পাওয়া যায়নি। এতে ইচ্ছেমত পাঠদানের জন্য শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছেনা।
শিক্ষকের পূর্ব প্রস্তুতির অভাব:
একজন শিক্ষককে প্রতিদিন ৫-৬ ছয়টি শ্রেণী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হয়। ফলে সবগুলোর পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব নয়। এটাও ঠিক যে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া পাঠদান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যা গুণগত মান উন্নয়নের বাধার সৃষ্টি করে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত অসামঞ্জস্য:
শিক্ষার্থী ভর্তি বৃদ্ধির ফলে শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৪০ হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে এ অনুপাত অনেক বেশী। একটি শ্রণীতে ১০০ জন শিক্ষার্থীকে থাকলে শিক্ষকের পাঠদান করা প্রায় অসম্ভব। পাঠদান করলেও মূল্যায়ন করা আরও কঠিন। ফলে সকল শিক্ষার্থী শিখন ফল অর্জন করল কি-না এটা মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। শিক্ষার্থী শিখন ঘাটতিতে পরে যা আর কাটিয়ে ওঠা যায় না। ফলে গুনগত মান অনেকাংশে কমে আসে।
পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু:
বিভিন্ন পরিবার ও সম্প্রদায়ের এমনকি বিভিন্ন ধরণের শিশু পড়ালেখা করে। ধরে নিতে হবে শ্রেণীকক্ষেই শিখন ফল অর্জন করাতে হবে। বর্তমানে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু অনেক বেশী বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু সংক্ষিপ্ত হলে সকল শিক্ষার্থী তা আয়ত্ব করতে পারবে।
পরিদর্শনের অভাব:
উর্দ্ধতন কর্মকর্তা কর্তৃক বিদ্যালয় পরিদর্শন একেবারেই কম। পর্যাপ্ত পরিদর্শনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ফলে গুণগত মানের অগ্রগতি জানা যাবে। প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সুচিন্তিত মতামত পাওয়া যাবে।