Thursday, May 31, 2012

শিক্ষক ঘাটতি ও শিক্ষার্থীর অনিয়মিত উপস্থিতি প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের প্রধান সমস্যা

প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষার মূল ভিত্তি। গ্রামে ধনী-দরিদ্র সকল শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়েই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণ গত মান বৃদ্ধি হলেও গুণগত মান বৃদ্ধি হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে শিক্ষক ঘাটতি ও শিক্ষার্থীর অনিয়মিত উপস্থিতি। এছাড়াও অন্যান্য কারণ রয়েছে।
শিক্ষক ঘাটতি:
আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কোনটি এক শিফটে আবার কোনটি দুই শিফটে পরিচালিত হয়। এক শিফট বিশিষ্ট বিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত ৫জন শিক্ষক পদ রয়েছে। অন্যদিকে দুই শিফট বিশিষ্ট বিদ্যালয়গুলিতে ৪ জন শিক্ষক পদ রয়েছে। ৫ জন এর অধিক পদ রয়েছে এরকম বিদ্যালয়ের সংখ্যা অতি নগন্য। এক শিফটে পরিচালিত বিদ্যালয়সমূহে যদি কোন শ্রেণীর শাখা না থাকে তবে সকাল থেকে একই সাথে ৫টি শ্রেণীর (১ম-৫ম) শ্রেণী কার্যক্রম শুরু হয়। এ কার্যক্রম চলে বিরতির আগ পর্যন্ত। এখানে সর্বক্ষণ ৫জন শিক্ষক থাকতেই হবে। অথচ বেশীর ভাগ বিদ্যালয়গুলোতেই শিক্ষক ঘাটতি বিরাজ করে। এছাড়াও রয়েছে শিক্ককের নৈমিত্তিক ছুটি, চিকিত্সা ছুটি, প্রসূতি ছুটি। একজন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে একটি শ্রেণীর কার্যক্রম কি করে সম্ভব তা সহজেই কল্পনা করা যায়। একজন শিক্ষককে একইসাথে ২টি শ্রেণীর কার্যক্রম চালাতে হয়। এ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে ২টি শ্রেণীরই শ্রেণী কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে শিক্ষার্থীকে শিখন ফল পুরোপুরি অর্জন করানো সম্ভব হয় না। চলতে থাকে শিখন ঘাটতি। যা পরবর্তীতে গুণগত মান উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করে। অপরদিকে দুই শিফট বিশিষ্ট বিদ্যালয়ে সবসময় শিক্ষক ঘাটতি বিরাজ করে। এমনও অনেক বিদ্যালয় আছে যেখানে একজন শিক্ষক পুরো বিদ্যালয় চালাচ্ছেন মাসের পর মাস। শিক্ষক ঘাটতি কোন সময়ই পূরণ হচ্ছে না। নতুন শিক্ষক নিয়োগ করা হলেও তারা চলে যায় এক বছরের জন্য সি-ইন-এড প্রশিক্ষণে। ফলে পদটি শূন্যই থেকে যায়। আবার নিয়োগ প্রাপ্তির পর শিক্ষক পদ পূরণ হলেও কোন শিক্ষক অবসর গ্রহন করলে তত্ক্ষণাত শিক্ষক নিয়োগের কোন ব্যবস্থা নেই। পরবর্তী নিয়োগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বলা যায় যে, শিক্ষক ঘাটতি চলমান থাকে। 
শিক্ষার্থীর অনিয়মিত উপস্থিতি:
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর বাত্সরিক গড় উপস্থিতি প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ। ১০০ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত করা এখনও সম্ভব হয়নি। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে। যদি ধরে নেয়া হয় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বছরের প্রদতিদিনই বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়। বাকী ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বছরের একাধিক দিন অনুপস্থিত থাকে। পাঠ দানের জন্য বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথম শ্রেণীতে গণিত বিষয়ের কথাই ধরা যাক। প্রথম দিন ১ ও ২ শেখানো হলো। পরের দিন ৩ ও ৪। যদি কোন শিক্ষার্থী পরপর দুই দিন অনুপস্থিত থাকে তবে সে ১, ২, ৩ ও ৪ শিখতে পারবেনা। ফলে তার শিখন ঘাটতি থেকে যাবে। এটা পূরণ করা সম্ভব নয়। এভাবে সকল বিষয়ে চিন্তা করলে শিক্ষার গুনগত মানের বিষয়টি সহজেই কল্পনা করা যায়।
বিরামহীন পাঠদান:
শিক্ষক সাধারণত বিরামহীনভাবে পাঠদান করেন। অর্থাত একটি শ্রেণী কার্যক্রম শেষ করে সাথেসাথেই আর একটি শ্রেণী কার্যক্রম শুরু করতে হয়। এভাবে চলে বিরতি পর্যন্ত। মাঝখানে একটুকুও বিরাম নেই। অথচ প্রতিটি পাঠদানের পূর্বে শিক্ষকের পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া পাঠদান ফলপ্রসু করা সম্ভব নয়।
শিক্ষকের আন্তরিকতার অভাব:
শিখন-শেখানো কার্যক্রম একটি টিম ওয়ার্ক। এখানে সকল শিক্ষককেই আন্তরিকতার সাথে পাঠদান করতে হবে। তানা হলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। অনেক শিক্ষক আছেন দায়সারা গোছের পাঠদান করে থাকেন।
শিক্ষক নির্দেশিকার অভাব:
অনেক জটিল বিষয় আছে যা পাঠদানের জন্য শিক্ষক নির্দেশিকার প্রয়োজন। কিন্তু বার বার পাঠ্য পুস্তক পরিবর্তনের ফলে পুরাতন নির্দেশকা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়েছে। এখন পর্যন্ত শিক্ষক নির্দেশিকা পাওয়া যায়নি। এতে ইচ্ছেমত পাঠদানের জন্য শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছেনা।
শিক্ষকের পূর্ব প্রস্তুতির অভাব:
একজন শিক্ষককে প্রতিদিন ৫-৬ ছয়টি শ্রেণী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হয়। ফলে সবগুলোর পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব নয়। এটাও ঠিক যে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া পাঠদান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যা গুণগত মান উন্নয়নের বাধার সৃষ্টি করে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত অসামঞ্জস্য:
শিক্ষার্থী ভর্তি বৃদ্ধির ফলে শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৪০ হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে এ অনুপাত অনেক বেশী। একটি শ্রণীতে ১০০ জন শিক্ষার্থীকে থাকলে শিক্ষকের পাঠদান করা প্রায় অসম্ভব। পাঠদান করলেও মূল্যায়ন করা আরও কঠিন। ফলে সকল শিক্ষার্থী শিখন ফল অর্জন করল কি-না এটা মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। শিক্ষার্থী শিখন ঘাটতিতে পরে যা আর কাটিয়ে ওঠা যায় না। ফলে গুনগত মান অনেকাংশে কমে আসে।
পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু:
বিভিন্ন পরিবার ও সম্প্রদায়ের এমনকি বিভিন্ন ধরণের শিশু পড়ালেখা করে। ধরে নিতে হবে শ্রেণীকক্ষেই শিখন ফল অর্জন করাতে হবে। বর্তমানে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু অনেক বেশী বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু সংক্ষিপ্ত হলে সকল শিক্ষার্থী তা আয়ত্ব করতে পারবে।
পরিদর্শনের অভাব:
উর্দ্ধতন কর্মকর্তা কর্তৃক বিদ্যালয় পরিদর্শন একেবারেই কম। পর্যাপ্ত পরিদর্শনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ফলে গুণগত মানের অগ্রগতি জানা যাবে। প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সুচিন্তিত মতামত পাওয়া যাবে।   

No comments:

Post a Comment